সহরোগ (কো-মরবিডিটি) এবং কোভিড-১৯

Share
Hospital Ward
 
Credit: Pixabay/vitalworks
 

আমাদের শরীর যখন মনে করে যে আমরা বিপদের মধ্যে রয়েছি, তখন দেহের ভিতর কিছু বিশেষ প্রক্রিয়া সচল হয়ে ওঠে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে শরীরের 'স্ট্রেস রেসপন্স'। কোভিড-১৯ এমন এক সংক্রমণ যা শরীরের 'স্ট্রেস রেসপন্স' কে চালু করে দেয়। একজন রোগীর যদি আগে থেকেই অন্য কোনো রোগ থেকে থাকে ( যাকে ডাক্তারী পরিভাষায় বলে কো-মরবিডিটি (comorbidity) বা বাংলায় সহরোগ ), তাহলে শরীরের এই 'স্ট্রেস রেসপন্স' শুরু করার ক্ষমতা কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ডায়াবেটিস রোগীর সাধারন সংক্রমণেও গুরুতর ভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী, কারণ তাদের দেহের সংক্রমণ প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতা কম।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুটো সমস্যার দিক রয়েছে। এর প্রথমটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়া। কোনো রোগীর যদি আগে থেকেই ডায়াবেটিস থেকে থাকে, বা কেমোথেরাপি হয়েছে, কিম্বা বার্ধক্যজনিত কারণে তাদের দেহের রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা কম, তাহলে ভাইরাসের জন্য সেটা একটা পরম সুযোগ। ভাইরাস তাদের শরীরে প্রবল বিক্রমে ছড়াতে থাকে, কারণ তাদের দেহে রাশ টেনে ধরার ক্ষমতা নেই।

দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো “সাইটোকাইন স্টর্ম”, যেটা সংক্রমণের ৮-১০ দিন পর থেকে শুরু হয়। আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধের তন্ত্র অতি-সক্রিয় ভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করে দেয়। এই অতি-সক্রিয়তার দরুণ দেহে প্রদাহজনক ধারা ( inflammatory cascades ) তৈরি হয় আর তার ফলেই দেহের আরও ক্ষতি হয়। শরীরের 'স্ট্রেস রেসপন্স' সাধারণত এই অতি-সক্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। কিন্তু যাদের শরীর আগে থেকেই অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত, তাদের দেহে এই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অনেক কম। 

কোভিড-১৯ এর সহ-রোগগুলির মধ্যে আমরা সবচেয়ে বেশী দেখতে পাই ডায়াবেটিস; এছাড়াও বিবিধ রোগের তালিকায় রয়েছে উচ্চরক্তচাপ এবং হৃদরোগ, কিডনীর রোগ, হাঁপানি এবং ক্যান্সার।

ডায়াবেটিস 

যাদের ডায়াবেটিস আছে, সাধারন নন-ডায়াবেটিক রোগীর তুলনায় তাদের রোগ গুরুতর হবার সম্ভবনা প্রায় দ্বিগুণ, এদের অনেক বেশী হারে আই সি ইউ (ICU)-তে ভর্তি করার দরকার পড়তে পারে। যে কোন সময়ে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ডায়াবেটিসের ওষুধের উপর নির্ভরশীল। 

ডায়াবেটিস সংক্রান্ত দুটো জিনিস আমরা দেখতে পেয়েছি।এক, নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ভীষণ রকম বেড়ে যাচ্ছে।  “সাইটোকাইন স্টর্ম” এর মোকাবিলা করতে রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়া হয়।কিন্তু এই স্টেরয়েডগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যার ফলে রোগীর রক্তে সুগারের (শর্করার) মাত্রা আরও বেড়ে যায়। দুই, যাদের আগে কখনও ডায়াবেটিস ছিল না, কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের পর তারা ডায়াবেটিস রোগের শিকার হয়ে পড়ছে। লন্ডনের কিংস কলেজ কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের কারণে ডায়াবেটিস হওয়া রোগীদের একটা বিশ্বব্যাপী তালিকা তৈরি করতে শুরু করেছে যাতে ভবিষ্যতে এদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়।

উচ্চরক্তচাপ

উচ্চরক্তচাপ আর একটা বিপদের কারণ। ভাইরাস আমাদের দেহে ঢোকে এসিই২ (ACE2) রিসেপ্টরের মাধ্যমে। এদিকে ওই এসিই২ রিসেপ্টরকে লক্ষ্য করেই উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। এই রিসেপ্টর মূলত ফুসফুসে থাকে, এছাড়াও থাকে অগ্নাশয় এবং ক্ষুদ্রান্ত্রে। সেই কারণেই রোগীদের অন্তঃস্রাবী তন্ত্রে (এন্ডোক্রাইন সিস্টেমে ) প্রচুর ক্ষতি হয়। একটি তত্ত্বের মতে, যেসব রোগীরা উচ্চরক্তচাপের জন্য এমন ওষুধ নিচ্ছেন যা সরাসরি এসিই২ রিসেপ্টরকে বাধা দেয়, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এই কারণেই নতুন করে যাদের উচ্চরক্তচাপ ধরা পড়ছে, তাদের এসিই২ রিসেপ্টরকে বাধা দেয় এরকম কোনো ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না।

দীর্ঘকালীন কিডনীর রোগ

দীর্ঘদিন ধরে কিডনীর রোগে ভুগে যাদের ডায়ালিসিসের মাধ্যমে চিকিৎসা চলছে, তাদের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রথমত যারা কোভিড-১৯ রোগে সংক্রামিত হচ্ছেন তাদের পক্ষে ডায়ালিসিসের চিকিৎসার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।এদের ঘনঘন হাসপাতালে আসতে হয় ডায়ালিসিসের জন্য, ফলে এদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হওয়ার সম্ভবনা খুব বেশী। তাই ১০-১৫ দিন অন্তর এদের জন্য কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করা হচ্ছে।

কোভিড-১৯ শুধু যে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে তা নয়, এটা রক্তবাহী নালীগুলিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই রোগের ফলে নালির মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে ব্লাড ক্লট তৈরি হওয়া বেড়ে যায়। যেসব রোগীদের ডায়ালিসিস চলছে, ডায়ালিসিসের যন্ত্রের মাধ্যমে এদের শরীরে রক্তকে ঘন থেকে পাতলা করে এমন রাসায়নিক (blood thinner - ব্লাড থিনার) ঢোকানো হয়। তা সত্ত্বেও কোভিড-১৯-এর রোগীদের রক্ত এমন ঘন হয়ে যায় যে আমাদের বেশি মাত্রায় ব্লাড থিনার ব্যবহার করতে হয়, অথবা ডায়ালিসিসের সময় সিআরআরটি ( কনটিনুয়াস রেনাল রিপ্লেসমেনট থেরাপি ) যন্ত্রে রক্ত পরিষ্কারের জন্য অন্য ধরণের উপায় অবলম্বন করতে হয়।

বার্ধক্য  

বেশিরভাগ বয়স্ক কোভিড-১৯ এর রোগীরা হাসপাতালে জ্বর বা শ্বাসকষ্টের উপসর্গ ছাড়াই চলে আসেন, কখনও দেহে ইলেক্ট্রোলাইটের সমস্যা, কখনো বা মানসিক বিভ্রান্তির জন্য। তারা আসেন কোন একটা অস্বস্তির কারণে। এর একটা কারণ হতে পারে যে, রোগ প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের শরীরে সাধারণত যে জ্বর আসে, অনেক সংক্রমণের ক্ষেত্রেই বয়স্ক মানুষদের শরীরে তা আসে না। বাড়িতেও তাদের আলাদা করে রাখা হয় এবং তারা চলাফেরাও খুব বেশী করেন না, ফলে শ্বাসকষ্টও খুব একটা হয় না। একবার যদি তারা হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় আর তার ফলে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

মেদবাহুল্য 

যাদের বি এম আই (বডি মাস ইনডেক্স -- Body  Mass Index ) ৩০-এরও বেশি তাদের ক্ষেত্রে রোগজনিত জটিলতার ঝুঁকি বেশি। অন্য কোনো রোগের উপসর্গ না থাকলেও শুধু মেদ বাড়ার জন্যই সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

সহরোগ সম্পন্ন রোগীদের চিকিৎসা  

বিভিন্ন সহ-রোগ সম্পন্ন রোগীদের চিকিৎসা এবং নিয়মিত নজরদারির জন্য অন্যরকম ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি যে স্টেরয়েড রোগীদের দেওয়া হচ্ছে সেটাও এদের ক্ষেত্রে আলাদা। যেমন ধরা যাক ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা মেথাইলপ্রেডনিসোলোনের জায়গায় ডেক্সামেথাসোন ব্যবহার করছি, কারণ মেথাইলপ্রেডনিসোলোন সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ওষুধে হার্টের ওপর পার্শপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যদি দেখা যায় যে লিভার ফাঙ্কশন টেস্ট স্বাভাবিকের থেকে বেশি, অথবা আগে থেকে যক্ষার (টিউবারকুলোসিস) মতো সংক্রমণ রয়েছে, তবে সে ক্ষেত্রে টোসিলিজুমাবের মতো সাইটোকাইন নিস্ক্রিয়কারি ওষুধ ব্যবহার করলে হিতে বিপরীত হবে। তাই কোনো ওষুধ দেওয়ার আগে আমরা সতর্ক থাকি আর রোগীর অন্যান্য রোগ আছে কিনা পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। 

প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে আমরা কিছু বিষয় বিচার করে একটা নম্বর দিই, আর তারপর বিভিন্ন তালিকা থেকে সেই রোগীর ঝুঁকির সম্ভবনা বোঝার চেষ্টা করি। এমনকি হাসপাতালে ভর্তির জন্যও আমরা ন্যাশনাল আর্লি ওয়ার্নিং স্কোর (এনইডবলুএস) এর মাপকাঠি ব্যবহার করি। এর সাহায্যে আমরা বলতে পারি একজন রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব, নাকি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে। সেপসিস-ইনডিউসড কোয়াগুলোপ্যাথি স্কোর এর সাহায্যে আমরা বুঝতে পারি কাদের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেশী।
 

যেসব রোগীর বিভিন্ন সহ-রোগ রয়েছে, তাদের আমরা হাসপাতালে একটু বেশি দিন রেখে দিই। ডায়াবেটিক রোগীদের অবস্থা স্থিতিশীল হবার পরে তাদের রক্তে যখন সুগারের মাত্রা কমে এমন পর্যায়ে আসে, যে বাকিটা তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন, একমাত্র তখনই আমরা তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়ি। বয়স্কদের ক্ষেত্রে আমরা তত দিন অবধি অপেক্ষা করি যতদিন না ওষুধের মাত্রা কমিয়ে এমন পর্যায়ে আনা যায় যে সেটা তারা নিজেরাই নিতে পারবেন। অন্তত পাঁচ দিন যদি কোনো উপসর্গ দেখা না যায়, তবেই তাদের ছাড়া হয়। বয়স্ক রোগীরা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসূচক ( যেমন রক্তচাপ, পালস রেট ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন কিনা দেখার জন্য আমরা একটা ছ’মিনিটের হাঁটার পরীক্ষা করি।  

বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধানকারী লোকের অভাবের ফলে চিকিৎসা করা বেশ কঠিন; তাই তাদের বাড়ির লোককেও ওয়ার্ডে রাখতে হয়। এখানে আমরা স্কিৎসোফ্রেনিক রোগীদেরও সামলেছি, যারা কারোর থেকে কিছুতেই চিকিৎসা নিতে চান না। 

কোভিড-১৯ ছাড়া অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রেও কোভিড-১৯ সমান্তরাল ক্ষতি করছে। দ্য ল্যান্সেট পত্রিকার এক সম্পাদকীয় অনুযায়ী ভারতবর্ষে এ বছর হাম, মাম্পস্ এবং রুবেলা রোগের টিকাদান ৬৯% কমে গেছে। বহু যক্ষা এবং ক্যানসারের রোগী রোগ নির্ণয়ের জন্য হাসপাতালেই যাননি, হয় কোভিড-১৯ রোগে সংক্রামিত হতে পারেন এই ভয়ে, নয়ত যাতায়াতের নিয়ন্ত্রণের জন্য। আমরা যখন আরও বেশী সাধারন রোগী দেখবো, খুব সম্ভবত এইসব রোগের অগ্রসর পর্যায়ের রোগীদের দেখতে পাব।

ডঃ মহিমা ভাস্কর মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার এবং ডঃ এল এইচ হিরানন্দানি হাসপাতালের ফুসফুসের রোগের চিকিৎসক। উনি কথা বলেছেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স (আই আই এস সি) র অফিস অফ কমিউনিকেশনস এর কমিউনিকেশন অফিসার রঞ্জিনী রঘুনাথ এর সাথে।